সন্ধ্যা

30/05/2013 16:56

আকাশের অবস্থা বেশি ভাল না। ডোবার জলে টুপ টুপ বৃষ্টি পড়ছে। সন্ধ্যা সেই বিকাল থেকে বড়শি নিয়ে বসে আছে। কোন মাছের দেখা নেই। ইদানিং ডোবায় তেমন মাছ বড়শিতে টুকায় না। হয়ত এখন ডোবায় তেমন মাছ নেই। আর আসবেই বা কত্তেকে। শীত কালে সেচ করে সব মাছ ধরা হয়। মা মাছ গুলো কে ধরে খেয়ে ফেললে মাছ আসবে কত্তেকে!


সন্ধ্যার বাবা খুব অসুস্থ। অসুস্থ বাবাকে ঘরে রেখে সে এখানে এসেছে মাছ ধরতে। বৃদ্ধ মানুষ। প্রতিদিন নিরামিষ খেতে ভাল লাগেনা। বাবার পিড়া পিড়িতে এখানে এসেছে সে। মা থাকতে মায়ের সাথে প্রায়ই এখানে মাছ ধরতে আসত সন্ধ্যা। মা মারা গেলেন গত বর্ষায়। মা মারা যাবার পর বাবা আরও অসুস্থ হয়ে গেলেন। আর কোন ভাই বোন না থাকায় সন্ধ্যাই বাবার দেখা শুনা করে। হালকা পাতলা গড়নের মেয়ে সন্ধ্যা। অনেকটা জহির রায়হানের হাজার বছর ধরে উপন্যাসের টুনির মত। বয়স আর কত হবে? বার কি তের! এই বয়সে যেখানে তার অন্যদের সাথে গুল্লা ছুট খেলার কথা ছিল সেখানে সে বাবার জন্যে মাছ ধরতে বৃষ্টির মধ্যে বসে বসে মশার কামড় খাচ্ছে!

চারদিক কেমন অন্ধ্যকার হয়ে আসছে। আজ আর কোন মাছ ধরতে পারেনি সন্ধ্যা। খালি খোলই নিয়ে বাসায় ফিরে সন্ধ্যা। বাবা খুব রাগ করবেন আজ। কিন্তু কি আর করা। তার তো কোন দোষ নেই। মাঝে মাঝে সন্ধ্যার খুব জানতে ইচ্ছে হয় ঈশ্বর কেন তাদের গরীব করে পৃথিবীতে রেখেছেন? হয়ত কাঁদায় ভর্তি রাস্তা ঘাট, জুলন্ত পায়খানা আর যত্রতত্র পড়ে থাকা আবর্জনার দুর্গন্ধে এ পাড়ায় ঈশ্বর আসতে চান না। হলেও হতে পারে! এসব ভেবে ভেবে বড়শি আর খোলই রাখে বারান্ধায়।

- বাবা!

- সন্ধ্যা আইছস মা!

- হ! বাবা!

- কিছু পাইলি?

- না বাবা! একটা টুকাও মারে নি।

- আরও কিছুক্ষণ বসে থাকতে পারলিনা পুড়া কপালি!

- বাবা বৃষ্টি বেড়ে গেল বলে চলে আসলাম।

- উনি আমার রাজকুমারি হয়েছেন! বৃষ্টিতে বিজতে পারবেন না।

- মাশাও কামড়াচ্ছিল খুব।

- ধুর হ! আমার সামনে আসবি না!

বাবা কাশতে থাকেন। যক্ষ্মা হলে যেমন কাশে মানুষ। সন্ধ্যা ঘরে ডুকে। এখনও আলো জ্বলে নি ঘরে। প্রদীপ জ্বলাতে গিয়ে মনে পড়ল ঘরে তো কেরোসিন নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে আগুন না দিলে বাবা সমস্ত ঘর চিল্লিয়ে মাথায় তুলবেন। সন্ধ্যা চট করে পাশের ঘর থেকে সামান্য কেরোসিন নিয়ে এসে আলো জ্বালায়।

সন্ধ্যার খুব মনে পড়ে এইতো এক বছর আগেও বাবা আমন ছিলেন না। কত হাঁসি খুশি আর চঞ্চল ছিল সন্ধ্যা দের ঘর। মা মেয়ে আর বাবা মাতিয়ে রাখতেন পুরো ঘর। বাবা নদীতে নৌকা দিয়ে মানুষ পার করার কাজ করতেন। সন্ধ্যা গাঁয়ের বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছিল। কত অনন্দে ভরা ছিল তাদের সংসার। এর পর কেমন সব কিছু উল্টা পাল্টা হয়ে গেল। মা কাজ করতেন শিকদার বাড়িতে। একদিন সিকদার বাড়ির কালা দেউ মায়রে আছর করল! মায়েরও কালা জ্বর হল। মা মারা গেলেন। বদলে গেলো সন্ধ্যাদের সংসার। দিন দিন বাবা অসুস্থ হতে থাকলেন, সাথে সাথে বাবার মেঝাজটাও খিটখিটে হয়ে গেল।

সন্ধ্যার খুব মনে পড়ে বাবা কখনোই এমন ছিলেন না। হাট থেকে ফেরার সময় বাবা প্রতিদিন সন্ধ্যার জন্যে কিছু নিয়ে আসতেন। হরি পাড়ায় পালা হলে বাবা মা আর সন্ধাকে নিয়ে যেতেন। কত মজাই না হত তখন। সারা রাত ধরে চলত পালা। সন্ধ্যা মায়ের কোলে মাথা রেখে একসময় ঘুমিয়ে যেত। দুর্গা পুজার সেই দিন গুলো। আহা কত আনন্দেরই না ছিল তার শৈশব।

- ঐ মাগী গেলি কই। আয় এদিকে আয়। আমার গলা টিপে মেরে ফেল।

- এইতো ভাত ভাঁড়ি।

সন্ধ্যা বাবার জন্যে ভাত নিয়ে আসে। সামান্য কয়টা সাদা ভাত, দুইটা কাঁচা মরিচ। ঘরে খাবার আর কিছু নেই। ভাত নিয়ে সন্ধ্যা যখন রসুই ঘর থেকে বাবার ঘরে যাচ্ছিল তখন আতু দৌড়ে আসে। আতু সন্ধ্যাদের পোষা কুকুর। সেই বাচ্চা বয়সে সন্ধ্যা একদিন ধরে নিয়ে এসেছিল আতুকে। সেকি নুদুস নুদুস ছিল আতু! সেই থেকে আতুই তার কাছের বন্ধু। অন্যদিন হলে সন্ধ্যা কিছু ভাত আতুকে দিত কিন্তু আজ দিল না। আজ ওর নিজের জন্যেই কিছু খাবার নেই।

সন্ধ্যা বাবার মুখের দিকে তাকায় না। ভয় পায় খুব। মাটির তালা বাবার সামনে রেখে সন্ধ্যা রসুই ঘরের দিকে পা বাড়ায় পানি নিয়ে যাবার জন্যে। পেছনে কিছু একটা পড়ার শব্দ শুনে পেছনে তাকায় সন্ধ্যা। সাদা ভাত গুলো পড়ে আছে বারান্ধায়। মাটির তালাটা কয়েক টুকরা হয়ে আছে। সন্ধ্যা নিজের রাগ গুলো নিয়ন্ত্রন করে। শুধু মনে মনে ভাবে মায়ের শেষ সৃতিও মুছে গেল এই বাড়ি থেকে। আতু দূরে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে থাকে।

চারদিক অন্ধকার হয়ে গেছে। হাস্নাহেনার ঘ্রানে পুরু বাড়ি ভরে উঠে। উঠানে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকায় সন্ধ্যা। মেঘ গুলোর অবিরাম ছুটে চলা দেখে কিছুক্ষন। না খেয়ে ঘুমালে বাবার শরীর আরও খারাপ করবে। অনিচ্ছা সক্তেও হরি পাড়ার দিকে পা বাড়ায় সন্ধ্যা। পিশি মাকে বলে যদি সামান্য কিছু খাবার বাবার জন্যে পাওয়া যায়। পিশি মা খারাপ মেয়ে না কিন্তু তার স্বামী হরিকেশ বাবুকে একেবারেই সহ্য করতে পারেনা সন্ধ্যা। লোকটা গঞ্জের স্কুল মাষ্টার। পাড়ার লোকদের শ্রদ্ধার সীমা নেই। অতচ এই লোকটাই......।

ছিঃ ছিঃ। একটা শুয়রের বাচ্চা। ভাবতেই গেন্না লাগে সন্ধ্যার। সুযোগ পেলেই শরীরে হাত দিতে চায়। বুড়ো লোকেরা কেন এমন হয় ভেবে পায়না সন্ধ্যা। শরীরে আতুর স্পর্শ অনুভব করে সন্ধ্যা। পরম মমতায় আতুর পিটে হাত রাখে সন্ধ্যা। সারা দিন না খেয়ে আছে কুকুরটা। বারান্ধার একটা ভাতও স্পর্শ করে দেখেনি। পশু আর মানুষের মধ্যে সুন্দর একটা পার্থক্য খুঁজে পায় সন্ধ্যা। মানুষ অভিনয় করতে পারে কিন্তু পশু পারেনা। আকাশে একটার পর একটা বিজলী চমকায়। সন্ধ্যা ঘাসের উপর খালি পা ফেলে হরি পাড়ার ধিকে এগিয়ে যায়।