ভিক্টোরিয়া এন্ড আলবার্ট মিউজিয়াম

27/02/2015 01:34

লন্ডনের মিউজিয়াম গুলো নিয়ে যখন ঘাটাঘাটি শুরু করি তখন থেকেই ভিক্টোরিয়া এন্ড আলবার্ট মিউজিয়ামের সাথে পরিচিত।  মিউজিয়ামটি লন্ডনের সাউথ ক্যাঞ্জিংটনে অবস্থিত। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আর্ট এন্ড ডিজাইন মিউজিয়াম। দেখতে দেখতেও যেন দেখা শেষ হয়না। এতে রাখা অবজেক্টের সংখ্যা ৪.৫ মিলিয়ন! কল্পনা করতে পারেন? মিউজিয়ামটিতে সব মিলিয়ে আমার বেশ কয়েক বার যাওয়া হয়েছে। সেটা অবজেক্ট গুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার জন্যেই।

এটি স্থাপন করা হয় ১৮৫২ সালে। তবে শুরুর দিকে মিউজিয়ামটি Museum of Manufactures নামে পরিচিত ছিল। পরে ১৮৫৪ সালে এর নাম পরিবর্তন করে South Kensington Museum দেয়া হয়। সর্বশেষ ১৮৯৯ সালের ১৭ই মে এর নাম পরিবর্তন করে  Victoria and Albert Museum নামকরন করা হয়। সাড়ে বার একর জায়গা নিয়ে অবস্থিত মিউজিয়ামটিতে মোট গ্যালারির সংখ্যা ১৪৫ টি। গ্যালারি গুলোতে প্রায় পাচ হাজার বছরের পুরাতন থেকে শুরু করে বর্তমান কালের বিভিন্ন আর্ট এন্ড ডিজাইন সম্পর্কিত অবজেক্ট রাখা হয়েছে।  এখানে এটাও উল্ল্যেখ করা যেতে পারে যে বর্তমান সময়ের London science museum সহ বেশ কিছু মিউজিয়ামের শুরু কিন্তু এই মিউজিয়াম থেকেই।  ১৮৩৭ সালে এই মিউজিয়াম থেকে নেয়া কিছু অবজেক্ট নিয়ে রয়েল কলেজ অব আর্ট তাঁর যাত্রা শুরু করে।  একই ভাবে ১৮৬০ থেকে ১৮৮০ সালেই বিজ্ঞান বিষয়ক অবজেক্ট নিয়ে যাত্রা শুরু করে লন্ডনের সাইন্স মিউজিয়াম যা পরে ১৮৯৩ সালে সম্পূর্ণ আলাদা মিউজিয়াম হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। 

ইতিহাস খুঁজলে জানা যায়, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময়ে অন্যান্য মিউজিয়ামের মত এই মিউজিয়ামের অবজেক্ট গুলোও পাশের পাতাল রেলওয়ে ষ্টেশনের টানেলে লুকিয়া রাখা হয়েছিল। তবে বড় অবজেক্ট গুলো মিউজিয়ামেই ছিল। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময়ে মিউজিয়ামটি জার্মান বোমা হামলার শিকার হয়। যার চিহ্ন এখনও দেখা যায়।

মিউজিয়ামটিতে প্রবেশের সময়ে বেশ কড়া সিকিউরিটি চেকের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। মানে সাথে রাখা ব্যাগ সম্পূর্ণ খুলে দেখাতে হয়। সিকিউরিটি অতিক্রম করেই অভ্যর্থনা কক্ষ। বিলেতের অন্যান্য মিউজিয়াম থেকে এই মিউজিয়ামের অভ্যর্থনা কক্ষ আমার কাছে আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। অভ্যর্থনা কক্ষে দাড়িয়ে মিউজিয়ামের মূল গুম্বুজটা দেখা যায়। সেই সাথে গুম্বুজ থেকে নিচের দিকে ঝুলিয়ে রাখা কাচের তৈরি ক্যান্ডলার দেখে মুগ্ধ হবে যে কেউ। নীল, সবুজ এর হলুদ কাচের কম্ভিনেশনে তৈরি ভাস্কর্যটি আলোক বিচ্চুরন করে।  মিউজিয়ামটিতে যত বার এসেছি তত বারই এখান থেকে মিউজিয়াম ঘুরে দেখার জন্যে প্রয়োজনীয় ম্যাপ এবং ম্যাগাজিন সংগ্রহ করি।  সব সময়েই রিসেপ্সনের সকল কর্মকর্তাকেই আন্তরিক মনে হয়েছে। এখানকার সরকারি কর্মচারীদের আচরন দেখলে যখন নিজের দেশের সরকারি কর্মচারীদের কথা মনে পড়ে মনে হয় আমরা এখনও সভ্যতার আলো পাইনি।

মিউজিয়ামটির ইসলামিক আর্ট গ্যালারী কেন জানি আমি আমার সকল ভ্রমনেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি। এই গ্যালারিতে সপ্তম শতাব্দী থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের মোট ১৯ হাজার ইসলামিক আর্ট অবজেক্ট রাখা হয়েছে। বিশেষ করে আল কোরআনের বিভিন্ন আয়াতের ক্যালিওগ্রাফি, সিরামিক, মিম্বর, কার্পেট উল্লেখযোগ্য।  

তবে এশিয়ান গ্যালারিতে এলেই মন খারাপ হয় সব সময়। সাউথ এশিয়ান গ্যালারিতে আমাদের মসলিন দেখে মন তো খারাপ হবেই। এই মসলিন আমাদের পরিচয়। ইন্ডিয়ান্দের পরিচয় যেমন তাজমহলে তেমনি আমাদের পরিচয় মসলিনে। তবে সেটা আর হয়ে উঠেনি। কেন উঠেনি সেটা আর নতুন করে বলার কিছু নেই।  তবে এই মিউজিয়াম ছাড়াও ডোবার মিউজিয়ামে আমি মসলিন দেখেছি। সেখানেও রাজ পরিবারের বেশ কিছু কাপড়-চোপড় সংরক্ষন করে রাখা হয়েছে। এছাড়া টিপু সুলতানের সৃতি বিজড়িত বাঘ আর ব্রিটিশ সৈনিক নিয়ে তৈরি করা খেলনাটি এই গ্যালারিতে রাখা হয়েছে। এই বিশেষ খেলনাটি তৎকালীন বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এছাড়া এই গ্যালারিতে মোগল সম্রাট শাহজাহানের পানি পানের কারুকার্য সম্বলিত পাত্রটি বিশেষ ভাবে নজর কাড়ে।  তবে বর্ণনায় বলা হয়েছে মদ পানের পাত্র।

মিউজিয়মটিতে একটি লাইব্রেরী আছে যার বই সংখ্যা প্রায় ৭৫০ হাজারেরও উপরে যা ন্যাশনাল আর্ট লাইব্রেরী নামে পরিচিত। ব্রিটিশ গ্যালারিতে প্রচুর অবজেক্ট রয়েছে। তাঁর মধ্যে হেনরি ৮ম এর লেখার বাক্স এবং Great Bed of Ware আমার বেশ ভাল লেগেছে।  এছাড়া টারজান কলাম দেখে অবাক হয়েছি। একসময় যা শুধু বইয়ের পাতায় দেখেছি বাস্তবে তা দেখার যে অনুভুতি তা লিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

আমি সবসময় ছবি তূলা খুব পছন্দ করি।  আগেই জানতাম এই মিউজিয়ামেই পৃথিবীর প্রথম আন্তর্জাতিক ফটোগ্রাফিক আক্সিবিশন হয়েছিল।  প্রথম যেবার এই মিউজিয়ামে এসেছিলাম সেবার যে কক্ষে আক্সিবিশন হয়েছিল সেই কক্ষে কিছুক্ষন দাড়িয়ে থাকলাম। সময়ের মেশিন ধরে চোখ বন্ধ করে অনুভব করার চেষ্টা করলাম আক্সিবিশনের প্রথম দিনটা কেমন ছিল।  পরে যতবার মিউজিয়ামে এসেছি সব সময়েই অল্প সময়ের জন্যে হলেও এই গ্যালারীতে ঘুরে এসেছি।

মিউজিয়ামটিতে প্রচুর ভাস্কর্য আছে। হাজার বছর আগে মানুষ কেমন করে অমন নিখুত কাজ করত আমার মাথায় আসেনা। সম্পূর্ণ মিউজিয়াম নিয়ে যদি লিখতে চাই তবে আলাদা করে একটা বই লিখে ফেলতে হবে। তবে ভিক্টোরিয়া এবং আলবার্ট মিউজিয়াম আমার জীবনের এমন একটি অভিজ্ঞগতা যা আমি কোন দিনই ভুলতে চাইব না।