বিলেতের পথে পথেঃ রিচমন্ড রয়্যাল পার্ক (প্রথম পর্ব)

06/07/2014 02:41

undefined

কোথাও বেড়াতে যাওয়া ব্যাপারটা ইদানিং আমার কাছে নেশার মত হয়ে গেছে। কয়েকদিনের মধ্যে কোথাও বেড়াতে না গেলে চিন্তা শক্তি লোপ পায় আমার। বেশ কিছুদিন থেকে চিন্তা করছিলাম দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়া উচিত। শহরের কোলাহল থেকে বাহিরে। যেখানে থাকবে পাখির কিচির মিচির আর বন্য প্রাণীদের বিচরন। তবে কোন সাফারি পার্কে হলে হবে না। সাফারি পার্কে বন্য প্রাণী স্বাধীনভাবে বিচরন করে ঠিকই। তবে আমাকে তো খাঁচায় থাকতে হয়। চাই এমন একটি জায়গা যেখানে বন্য প্রাণীকে ছুঁয়ে দেখা না যাক অন্তত মাঝখানে কোন খাঁচার দেয়াল থাকবে না।

অবশেষে ইন্টারনেটে খুঁজা খুঁজি করে এরকম একটি জায়গার খোঁজ পাওয়া গেল। রিচমন্ড রয়্যাল পার্ক! সংরক্ষিত বনাঞ্চল। লন্ডন শহরের ব্যাস্ততা থেকে খনিকটা দূরে। বিশাল এক পার্ক। এটিই লন্ডনের সবচেয়ে বড় রয়েল পার্ক। আর ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় বৃহত্তম পার্ক। একে অনেক ভাবেই পরিচয় করিয়ে দেয়া যায় পাঠকের কাছে। উড ল্যান্ড, ঘ্রাস ল্যান্ড, ডিয়ার পার্ক বা অন্য আরও অনেক নামে।


গুগল স্যাটেলাইট থেকে তুলা রিচমন্ড পার্কের ছবি

দেখে বুঝার উপায় নেই একজন সুন্দর মনের মানুষ শুধু মাত্র নিজের ইচ্ছায় তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন এই বিশাল বনাঞ্চল। আমাদের দেশে যেখানে আমরা প্রাকৃতিক বন কেটে সাবাড় করছি সেখানে এরকম হাতে তৈরি করা বিশাল বনাঞ্চল শুধুই কল্পনা! কি নেই এখানে! সকাল থেকে সন্ধ্যা পাখির কিচিরমিচির। টিয়ে, কাঠ টুকরা, ম্যান্ডারিন, হরেক প্রজাতির হাস সহ নাম না জানা হাজার রকমের পাখি! ছোট ছোট কাঠবিড়ালি, খরগুস, আর যাদের কথা না বললেই নয় সেই রেড ডিয়ার আর ফেলো ডিয়ার! আছে হাজার প্রজাতির শত বছরের পুরাতন বৃক্ষরাজি! এ যেন একজন প্রকৃতি প্রেমিকের স্বর্গ রাজ্জ্য!


এরকম উড ল্যান্ড ধরেই আপনাকে হাটতে হবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা

লন্ডন ব্রিজ স্টেশনে নেমে বুঝলাম লন্ডনের তাপমাত্রা খারাপ না। ২০-২২ ডিগ্রি হবে। আমি মাইনাস ২০ ডিগ্রি সহ্য করতে পারব কিন্তু ২০ ডিগ্রি তাপমাত্রা! আমি সহজেই হাঁপিয়ে উঠি! বাংলাদেশের গরম আর এদেশের গরমের মধ্যে আমি খুব সুন্দর একটা পার্থক্য খুঁজে পেয়েছি। অনেকটা ওভেন আর প্যানের মত। ওভেনে খাবার ভিতর থেকে গরম হয় আর প্যানে প্রথমে বাহির তার পরে ভিতর। এ দেশে প্রচণ্ড গরমেও শরীর তেমন ঘামবে না কিন্তু ভিতরে অশান্তি করবে প্রচণ্ড রকম। শীতের সময়েও একই অবস্থা। আপনি খালি গায়ে হাটতে পারবেন সমস্যা নেই। কিন্তু একটু পরেই বুজতে পারবেন। আর একবার ঠাণ্ডা লাগলে খবর আছে। এক বছরেও না সারতে পারে!


পার্কের প্রধান আকর্ষণ রেড ডিয়ার

লন্ডন ব্রিজ স্টেশন থেকে পায়ে হেটে চলে এলাম মনোমেন্ট পাতাল স্টেশনে। এখান থেকে ডিস্ট্রিক লাইন ট্রেনের শেষ স্টপ রিচমন্ড। লন্ডনের এই ট্রেন আর বাংলাদেশের মেইল কিংবা মিস ট্রেনের মধ্যে আমি তেমন পার্থক্য খুঁজে পাই না। চলছে তো চলছেই। প্রায় ১ ঘণ্টা লেগে গেল। আগেই ইন্টারনেট থেকে দেখে নিয়েছিলাম ৬৫ এবং ৩৭১ নাম্বার বাস ধরে আমাকে যেতে হবে পার্কে। স্টেশন থেকে বের হয়েই চড়ে বসলাম ৬৫। যেহেতু একটু কনফিউজ ছিলাম তাই ড্রাইভারকে আগেই বলে রাখলাম আমাকে যেন সঠিক জায়গায় নামিয়ে দেয়।


এ যেন এক স্বপ্নপূরী

প্রস্তুত ছিলাম প্রচুর হাটতে হবে আজ। রোযা রেখেছি! সাড়ে ১৯ ঘণ্টার রোযা! সেই সাথে প্রচণ্ড গরম। আগে থেকেই সিলেক্ট করা ছিল কোন রাস্তায় কতটুকু হাটবো। কি কি দেখব। এক হাতে ইন্টারনেট থেকে প্রিন্ট করে আনা পার্কের ম্যাপ আর অন্য হাতে ক্যামেরার ট্রাই পড। কাধে ব্যাগ গলায় ক্যামেরা। শুরু হল হাটা। গন্তব্য শুরুতেই পার্কের একদম কেন্দ্রে যাওয়া। এখানে অন টপিক একটা কথা বলে নেই, আপনি যদি এই পার্কে খুব সহজেই রেড ডিয়ার আর ফেলো ডিয়ারের দেখা পেতে চান তাহলে শুরুতেই আপনাকে পার্কের একদম কেন্দ্রে চলে যেতে হবে। সব মিলিয়ে এখানে ৬৩০ টি হরিন আছে। তবে পার্কটাও যে বিশাল এলাকা জুড়ে! ৩ দশমিক ৬৯ বর্গ মাইল! তাই হাটতে হবে ধৈর্য ধরে আর প্লান করে।


ফেলো ডিয়ার

ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, ১৬৩৪ সালে এই পার্কটি তৈরি করেছিলেন ইংল্যান্ডের রাজা চার্লস প্রথম অনেকটা শখের বসে। রেড ডিয়ার তখন বিলুপ্ত হচ্ছিল। বিশেষ করে ইউরোপ থেকে। তার ইচ্ছাতেই অনেকটা তিলে তিলে তৈরি করা হল এই বিশাল পার্ক! সম্পূর্ণ এলাকা দেয়াল ঘেরা করে প্রথমে জনসাধারন থেকে আলাদা করে দেয়া হলেও সাধারণ জনগন সেটা ভাল ভাবে না নেয়ায় তিনি এটি শুধুমাত্র পথচারীর জন্যে খুলে দেন। তবে পার্কের দেখা শুনা করার জন্যে ১২ পেনি (তখনকার) রোজে জেমি ওয়াটসন নামের একজন পার্ক কিপার নিয়গ করেন। তবে গৃহ যুদ্ধের পর মানবতা বিরুধি অপরাধের জন্যে পার্লামেন্টেরেয়ানরা তাকে শিরশ্ছেদ করে হত্যা করলে পার্কটি রাজ পরিবারের আওতার বাহিরে চলে যায়। পরে ১৬৬০ সালে চার্লস দ্বিতীয় এর শাসন আমলে পার্কটি আবারও রাজপরিবারের আওতায় আনা হয়। ১৯৫১ সালে প্রিন্সেস আমেলিয়া পার্কের রেঞ্জারের দায়িত্ব নিলে তিনি পার্কটিতে আবারও জনসাধারনের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেন। পরে জন লুইস নামের একজন আদালতে মামলা টুকে দিলে ১৮৭২ সালে পার্লামেন্ট অ্যাক্টের মাধ্যমে এটি আবারও খুলে দেয়া হয়। তবে উল্ল্যেখ করে দেয়া হয় এখান থেকে কেউ জ্বালানি কাট সংগ্রহ করতে পারবে না। ১৭৪৬ সালের দিকে পার্কে একটি লেক খনন করা হয় জলজ পাখীদের অভয়ারণ্য তৈরি করার নিমিক্তে। সেই সাথে পার্কে তৈরি করা হয় বেশ কয়েকটি লজ। তার মধ্যে Pembroke Lodge এবং White Lodge অন্যতম।

Pembroke Lodge

আমি হেটে হেটে Pembroke Lodge এ চলে এলাম। তখন পর্যন্ত একটি হরিণেরও দেখা নেই। হাঁটছি তো হাঁটছি। লজের সামন থেকে সম্পূর্ণ টেমস ভেলি দেখা যায়। ভিউটা অসাধারণ! এখানে ভিজিটরদের বসার জন্যে সুন্দর ব্যাবস্থা আছে। সেই সাথে ১৭৫৪ সালের দিকে নির্মিত এই লজটি বর্তমানে একটি রেস্তুরা। তবে জানা যায় ১৮৪৭ সালে রানী ভিক্টোরিয়া তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী Lord John Russell‘কে বসবাসের জন্যে প্রদান করেছিলেন এই লজটি। জায়গাটাতে না আসলে কল্পনাও করতে পারবেননা জায়গাটা কতটা সুন্দর। সামনে অসাধারণ টেমস ভেলি, ফুলের বাগান আর পাখির কিচিরমিচির! কাঠের একটি বেঞ্চিতে বসে প্রেমিকার হাত ধরে কবিতা আবৃতি করার মত রোমান্টিক একটি জায়গা।

আমার পরের গন্তব্য King Henry's Mound, অসাধারণ একটি জায়গা। পার্কটা বিশাল এলাকা নিয়ে তাই প্লান করে কিছু জায়গা যেমন বাদ দিয়েছি তেমনই প্লান করে কিছু জায়গা ঘুরে দেখার জন্যে রেখেছিলাম। এটি তার অন্যতম। এই জায়গাটার অন্যতম বৈশিষ্ট হচ্ছে এখান থেকে প্রায় ১৬ কিলো মিটার দূরের লন্ডন শহরের ভিতরে অবস্থিত St Paul's Cathedral প্রায় পরিষ্কার ভাবে দেখা যায়। সেই সাথে একই লাইনে London Eye, Natwest Tower এবং The Gherkin চোখে পড়ে পর্যটকদের। লন্ডনের বিখ্যাত এই স্থাপনা গুলো একই সাথে অনেক দুর থেকে দেখার মজাই আলাদা।


King Henry's Mound থেকে সেন্ট পাওয়েল'র অসাধারণ ভিউ

এছাড়া কথিত আছে, কিং হেনরি দ্যা এইট (কিং হেনরি দ্যা এইট সম্পর্কে বিলেতের পথে পথে’র ভুতের দুর্গে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে ) তার প্রথম স্ত্রী অ্যান বলিনের শিরশ্ছেদের দিনে এখানে বসে অপেক্ষা করছিলেন টাওয়ার অব লন্ডন থেকে শিরশ্ছেদ সমাপ্তি সূচক সংকেত হিসাবে একটি ফায়ার রকেট ছুড়া দেখার জন্যে। যাতে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারেন। এছাড়া ধারনা করা হয় তম্র যুগে এই জাগাটি একটি burial chamber হিসাবে ব্যাবহার করা হত। বর্তমানে এখানে একটি টেলিস্কোপ বসানো হয়েছে পর্যটকদের জন্যে। (চলবে)