ইংলিশ চ্যানেল এবং আমার প্রিয় রটিংডেন ভিলেজ

15/04/2012 12:24



undefined

আপনার অনেকেই হয়ত ইংলিশ চ্যানেলের সাথে পরিচিত। আমার যতদূর মনে পড়ে ছোট বেলা কোন এক সাধারন জ্ঞান বইয়ে পড়েছিলাম, কোন মানুষ সর্ব প্রথম সাঁতার কেটে ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করেন? আর পর থেকে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম কখন সেই দিন আসবে যেদিন আমি নিজেও ইংলিশ চ্যানেলে সাঁতার কাটবো। কেটে ছিলামও!! সে গল্প আরেকদিন হবে। আজকের পর্বে ইংলিশ চ্যানেলকে আপনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেব।


(Rotting den village-এ ইংলিশ চ্যানেলের সৈকতে)


(Rotting den village-এ ইংলিশ চ্যানেলের সৈকতে)

আপনাদেরকে একটি মজার তথ্য জানাই, আপনারা কি ব্রজেন দাস নামের কাউকে চেনেন? আরেকটু খুলাসা করি, মাহান এই মানুষটির বাড়ি বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুর গ্রামে। তাও চিনতে পারলেননা! ওকে! আরেকটু তথ্য দেই। তিনি ১৯৫৬ সালে অলিম্পিকে সাতারে তৎকালীন পাকিস্তান দলের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। যিনি ১৯৬১ সালে বিশেষ কিছু করার জন্যে কুইন এলিজাবেথের কাছ থেকে পুরস্কার পেয়েছিলেন। তাও চিনতে পারলেন না?


(ক্লিফের সামনে আমি)


(সামুদ্রিক প্রবাল)


(সামুদ্রিক প্রবাল)

সমস্যা নেই। আমিই বলছি, তিনিই সেই ব্যাক্তি যিনি প্রথম এশিয়ান হিসাবে সাঁতার কেটে ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করেন। শুধু কি তাই? তিনিই একমাত্র সাতারু যিনি মোট পাঁচ বার সাতার কেটে ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করেন। সাল গুলো ছিল যতাক্রমে ১৯৫৯(দুই বার), ১৯৬০, ১৯৬১(দুই বার)।


(সামুদ্রিক প্রবাল)

ইংলিশ চ্যানেল হচ্ছে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মধ্যকার একটি প্রণালী যা দক্ষিন মহাসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগরকে যুক্ত করেছে। এটি প্রায় ৫৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং প্রস্থে ৩৪ কিলোমিটার থেকে ২৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত। যা আয়তনের দিক দিয়ে প্রায় ৭৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। এর গভীরতা ৪৫ মিটার থেকে ১২০ মিটার পর্যন্ত। চ্যানেলটির মধ্যে অনেক গুলো দ্বীপ রয়েছে, যার মধ্যে Isle of Wight এবং Isles of Scilly উল্লেখ যোগ্য। ধারনা করা হায় প্রায় ১৮০ হাজার থেকে ৪৫০ হাজার বছর পূর্বে ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট বন্যা থেকে যে ভৌগলিক পরিবর্তন হয় তার ফলেই এই চ্যানেলের সৃষ্টি।


(গলফ ক্লাবের সামনে আমি)

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় যে, এটি মুলতঃ ১৮ শতকের শুরুর দিক থেকে ইংলিশ চ্যানেল হিসাবে পরিচিত হয়ে আসছে। অনেকে একে ব্রিটিশ চ্যানেল হিসাবেও বর্ণনা করেছেন। আরও পেছনে ১৬ শতকের দিকে গেলে দেখা যায় ডাচ ম্যাপ গুলোতে একে "Engelse Kanaal" হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও দ্বিতীয় শতকের বিশিষ্ট ভূগোলবিদ Ptolemy তার "Oceanus Britannicus" -এ একে ব্রিটিশ সাগর হিসাবেও উল্লেখ করেছেন যা ১৪৫০ শতকের ইতালিয়ান ম্যাপ গুলোতেও রয়েছে।


(আহা এভাবে যদি প্রতিদিন বসা যেত!)

প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের হাজার সৃতি বহন করা এই চ্যানেলটিই হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যাস্ত সগর পথ যা দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৫০০ টির উপরে জাহাজ চলাচল করে। প্রচণ্ড নিরাপক্তার পরেও বেশ কয়েকটি জাহাজ এ চ্যানেলে দুর্ঘটনার শিকার হয়। প্রথম দুর্ঘটনাটি ঘটে ১৯৭১ সালে। পরে ২০০২ সালের ডিসেম্বরে অতিরিক্ত কুয়াশার করনে MV Tricolor নামের কার্গো জাহাজ প্রায় ৩০ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যমানের বিভিন্ন বিলাস বহুল গাড়ি সহ ডুবে যায়।


(Brighton marina থেকে ইংলিশ চ্যানেল)

মজার ব্যাপার হচ্ছে চ্যানেলটির নিচ দিয়ে একটি টানেল আছে যা দিয়ে ইংল্যান্ড থেকে ফ্রান্সে যাওয়া যায়। এছাড়া ফেরীর মাধ্যমেও ফ্রান্সে যাওয়া আসা করা যায়।


(Wind mill-এর সামনে আমি)


(Wind mill-এর সামনে আমি)


(Wind mill-এর সামনে আমি)


(Wind mill-এর সামনে আমি)

আল্লাহ্‌ আমার ইচ্ছা এমন ভাবে কবুল করলেন যে, এই ইংলিশ চ্যানেলের পাড়ে আমার জীবনের কত সৃতিই না জড়িয়ে গেল! আমি যে বাসায় থাকথাম তার জানালা দিয়ে সমুদ্র দেখা যেত। আমার জানালা থেকে সমুদ্রের ডেউয়ের দুরত্ব ছিল মাত্র ৩০ সেকেন্ডের পথ! আর আমি যে শপে কাজ করতাম তা সমুদ্র পাড়েই ছিল! ফলে সমুদ্রকে দেখা হয়েছিল একদম কাছ থেকে। অনেক দিন।


(Hove-এ ইংলিশ চ্যানেল)


(বন্ধুদের সাথে ক্রিকেট খেলার একটি মুহূর্ত)


(বড়শি দিয়ে জ্যোৎস্না রাতে চ্যানেলে মাছ ধরছি আমি ও আরও কয়েক জন)

কত জ্যোৎস্না রাত কাটিয়েছি সমুদ্র পাড়ে বসে তার কোন ইয়াক্তা নেই। ছোট বেলা থেকে সূর্যাস্ত আর সূর্যোদয় দেখার কত শখ ছিল যা এখানেই পুরা হয়েছিল। এখনও মনে পড়ে সবাই মিলে রাতে সমুদ্র পাড়ে ফুটবল আর দিনের বেলা ক্রিকেট খেলার কথা! আজ সবাইকে খুব মিস করি। মনে পড়ে সবাই মিলে রাতে সমুদ্র সৈকতে কয়লার আগুনে পুড়ে পাখি আর খরগুসের মাংস খাওয়ার দৃশ্য। যা আজ কেবলই সৃতি। কাজের চাপে আজ অনেকের সাথে কথা বলারও সময় পাইনা। তবে সত্যি বলছি তোমাদের খুউব মিস করি। ভাল থেক তোমরা।


(সমুদ্র পাড়ে BBQ পার্টি)

আমার জীবনের অনেক আনন্দ আর কষ্টের সৃতি আছে এর প্রতিটি ঢেউয়ে। আশ করি পরবর্তী পর্ব গুলোতে আপনাদের সাথে শেয়ার করতে পারব ইনশাআল্লাহ্‌।


(সমুদ্র পাড়ে BBQ পার্টি)

আপনারা যারা এখানে আসতে চাইবেন তাদের জন্যে বলছি, আপনারা এটি দেখার জন্যে তিনটি জায়গা বেচে নিতে পারেন। একঃ Kent-এর Dover শহর, দুইঃ Sussex-এর Brighton, Rotting den village, Brighton marina, hove, Eastbourne শহর, তিনঃ Portsmouth- এর Isle of Wight দ্বীপ। এ সবগুলো জায়গা থেকেই আমার ইংলিশ চ্যানেল দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। একেক জায়গা থেকে এর রূপ একেক রকম।


(ডোবারে ইংলিশ চ্যানেল)

(রাতের ফোটবল খেলা)


(ইংলিশ চ্যানেলে সূর্যাস্ত)

লন্ডনের king cross international station থেকে সব গুলো শহরেই আপনি যেতে পারবেন ট্রেনে করে। আপনি যদি high speed-এর ট্রেনে Dover আসেন, তাহলে আপনার ৫০ মিনিটের মতো সময় লাগবে তবে high speed-এর টিকেটের দাম একটু বেশি পড়বে। অন্যদিকে যদি national ট্রেনে আসেন তবে আড়াই ঘণ্টার চেয়েও বেশি সময় লাগতে পারে। এখান থেকে ফেরিতে করে ফ্রান্সে যাওয়া যায়। সেই সাথে ট্রেনেও। প্রাইভেট গাড়ি নিয়েও চ্যানেলটির নিচের টানেল দিয়ে ফ্রান্সে যাওয়া যায়। আর যদি Brighton-এ আসতে চান তবে ৫০ থেকে ৬০ মিনিট সময় লাগবে যেকোন ট্রেনেই। এক্ষেত্রে ইন্ডিয়ান মালিকানাধীন First capital connect service-এর ট্রেন গুলো avoid করার চেষ্টা করবেন কারন এ ট্রেন গুলো অনেক আস্তে চলবে এবং সময় বেশি নেবে। এখানকার Kemp town কে পৃথিবীর Gay capital বলাহয়। এখান থেকে ইংলিশ চ্যানেল দেখার পাশাপাশি Palace pair(চ্যানেলের উপরে নির্মিত সবচেয়ে বড় এবং আকর্ষণীয় পেয়ার), Brighton palace(এটা অনেকটা ভারতের তাজমহলের মতোকরে নির্মিত রানীর বাড়ি), Brighton marina (সমুদ্রের পানির উপরে তৈরি বিশাল নান্দনিক শহর), Ratting den village দেখে যেতে পারেন। যদি আপনি Portsmouth-এ যাওয়ার ইচ্ছা থাকে তবে আপনাকে Southampton-এর ট্রেনে উঠতে হবে। এক্ষেত্রে একসাথে অনেক গুলো ইচ্ছা পূরণ হবে। একঃ Isle of Wight দ্বীপ দেখা, দুইঃ ইংলিশ চ্যানেল দেখা, তিনঃ যে জায়গা থেকে টাইটানিক আমেরিকার জন্যে যাত্রা করেছিল সেই বন্দরটাও দেখা হবে। তবে লন্ডন থেকে Southampton-এ যেতে মুটামুটি ৬০ মিনিটের চেয়ে সামান্য বেশি লাগতে পারে।