পাখি বন্ধু রফিক

24/05/2013 15:09

মা পাখিটা প্রখর রৌদ্রের মধ্যে ডিমে বসে তা দিচ্ছে। বাবা পাখিটাকে অনেকক্ষণ ধরে আশেপাশে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। সম্ভবত খাবারের সন্ধানে বাহিরে গেছে। আজ আট দিন হল ডিমে তা দিচ্ছে। আর কিছু দিনের মধ্যেই ডিম ফুটে বাচ্ছা বেরুবে। বাবা পাখিটা বেজায় খুশি। এদিক সেদিক ছুটিছুটি করে সে। মা-বাবা দুজনেই পালা করে ডিমে তা দেয়। এভাবেই চলছিল তাদের সুখের দিনগুলো।


রফিক পাখিগুলকে ছেড়ে একদম থাকতে পারছিলনা। তাই মামা বাড়ি গিয়েও পাখি দুটির জন্যে তার মন ছটফট করতে লাগলো। বাড়ি ফিরে আসার জন্যে রফিক বারবার মাকে বিরক্ত করতে লাগলো।

কিছুদিন পর যখন ফিরল তখন কাপড় না খুলেই চলে গেল পুকুর পাড়ে, সেখানে পাখি দম্পতির বাসা। কিছু দূর থাকতেই তার কানে ছানা পাখিদের কিচির মিচির শব্দ ভেসে এলো। ছানা দুটোর কিচির মিচির শব্দে রফিকের ছোট্র মনটি আনন্দে নেচে উঠলো। মা পাখিটা ছানা দুটোকে আদর করছে আর বাবা পাখিটা গাছের ডালে বসে মনের আনন্দে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। রফিকের আনন্দ তখন দেখে কে? সে বাড়ির দিকে দিল এক দৌড়। তারপর বাড়িতে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল- মা আজ তোমাকে খু-উ-ব মাজার একটা জিনিস দেখাব।। চল মা আমার সাথে।

রফিকের মা তখন রান্না করছিলেন। তাই ছেলেকে বললেন, আমি এখন কাজ করছি সোনামনি একটু পরে দেখব। কিন্তু রফিক নাছোড় বান্দা। মাকে জোর করে পাখির বাসার নিকট নিয়ে গেল। এরপর মাকে ছানা দুটো দেখিয়ে বলল দেখ মা ছানাগুলো কি সুন্দর! এমন সময় মা পাখিটা মধুর সুরে ডেকে উঠল। রফিক মাকে জড়িয়ে ধরে বলল জান মা, মা পাখিটা ছানা দুটোকে কি বলল? কি করে বুজবো! আমি তো আর পাখিদের ভাষা বুজিনা। রফিক তখন বিজ্ঞের মতো করে বলল- মা পাখিটা ছানা দুটোকে বলল, এই দেখ তোমাদের দাদু তার মাকে নিয়ে তোমাদের দেখতে এসেছেন। ছেলের পাকামো দেখে রহিমা বেগম ছেলেকে কোলে নিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বললেন, আব্বু তুমিতো দেখছি খুব পাকা হয়ে গেছ। এর পর তিনি হাসি মুখে রান্না ঘরের দিকে চলে গেলেন। এভাবেই কেটে গেল কয়েক দিন।

পরদিন সকালে রফিক পাখির বাসার কাছে গিয়ে দেখল বাসায় একটি ছানা নেই। মা ও বাবা পাখিটা এদিক-ওদিক উড়া উড়ি করছে আর করুন সুরে ডাকছে। মনটা তার চ্যাৎ করে উঠল। রফিক মনে মনে ভাবল তাহলে গত রাতের ঝড়ে ওদের একটি ছানা হারিয়ে গেছে? রফিক বাসার নিচের চারদিক ব্যাস্ত হয়ে খুজতে লাগলো।
রফিককে কিছু খুজতে দেখে তাদের পাড়ার সোহেল তাকে জিজ্ঞেস করলো, “কি-রে রফিক কি খুঁজছিস?” রফিক সংক্ষেপে বলল, “একটি পাখির ছানা হারিয়ে গেছে ওটাই খুঁজছি”।
ওরে বোকা ওটাতো সেই সকালেই আমি ধরে নিয়ে গেছি। ভাবছি ঐ ছানাটিও ধরব।
রফিক চিৎকার দিয়ে বলল, সোহেল তাহলে তুই ছানাটি চুরি করেছিস?
দেখ এভাবে বলবি না বলছি খারাপ হবে কিন্তু!
কেন বলব না একশো বার বলবো হাজার বার বলবো। তুই ছানা চুরি করেছিস তুই চুর। আমি এখনই তোদের বাড়িতে গিয়ে ছানাটা ছেড়ে দিচ্ছি। এ কথা বলেই রফিক সোহেলদের বাড়ীর দিকে দৌড়াতে লাগলো। যেই মাত্র রফিক পাখির খাঁচায় হাত দিল অমনি সোহেল খপ করে রফিকের হাত ধরে হুংকার দিয়ে বলল, এখনও সময় আছে বাড়ি চলে যা বলছি। ফের যদি খাঁচার দিকে হাত বাড়াবি তাহলে হাতটা একদম ভেঙ্গে ফেলব বলছি। রফিক যখন যখন জোর করে খাঁচার দরজা খুলতে চাইল তখন সোহেল তার উপর জাপিয়ে পড়লো। ধারাল নখের আঘাতে রফিকের শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্ত ঝরতে লাগলো। রফিকের চিৎকার শুনে সোহেলের মা দৌড়ে এলেন। মায়ের ভয়ে সোহেল দৌড়ে পালিয়ে গেল। আর রফিক তখন সুযোগ বুঝে দৌড়ে খাঁচার কাছে গিয়ে খাঁচার দরজাটা মেলে ধরল। কিন্তু তখন আর ছানাটি জীবিত নেই, পড়ে আছে তার প্রান শূন্য দেহটি। রফিক ছানা পাখিটাকে হাতে নিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।

সেদিন রাতে রফিকের খুব জ্বর উঠল। ডাক্তার এসে রফিককে ঔষধ দিয়ে গেলেন। কিন্তু কিছুতেই রফিকের জ্বর কমল না। জ্বরের ঘোরে রফিক এক সময় পাগলের মত প্রলাপ বকতে লাগলো।
সোহেল তুই পাখির ছানা চুরি করেছিস তুই চুর। দেখ মা! পাখির ছানা গুলো কত সুন্দর। দেখ না ওরা কি সুন্দর গান গায়। দেখ মা ওরা আমাকে নিতে এসেছে। এ রকম হাজার প্রলাপ তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসতে লাগলো। এক সময় রফিক মায়ের কাছ থেকে শেখা কবি আল মাহমুদের লেখা তার প্রিয় সেই ছড়াটি আবৃতি করতে লাগলো-

“যেই ছেলেটা বৃক্ষ কাটে
পুষ্প ছেঁড়ে
ভাঙ্গে পাখির বাসা;
সে তো কেবল ফড়িং ধরা
বৃক্ষে চড়া
ভাবে খেল তামাশা।

হাজার হাজার মাখলুকাতের
প্রতি যাদের নেই সামান্য মায়া,
তাদের ছায়া এড়িয়ে চলো
তাদের রাখো দূরে।

প্রকৃতিকে বাঁচায় যারা
সেই শিশুরা বাঁচুক জগত জুড়ে।
তার সাথে দাও আড়ি
ফুল পাখিকে কাঁদায় যারা
যেও না তার বাড়ি।”

রহিমা বেগম রফিককে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। রফিক মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “ জান মা, ছানা দুটো আমাকে তাদের বাসায় যাওয়ার জন্যে দাওয়াত দিয়েছে। আমাকে যেতে দাওনা মা, আমাকে যেতে দাও!

জ্বরের গোরে রফিক সারা রাত প্রলাপ বকল। এক সময় মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিনের আজানের সুর ভেসে এল। রফিকের জ্বরও কমে গেল। শিতল হয়ে গেল তার সমস্ত শরীর। মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লো রফিক। অনন্ত সে ঘুম, চিরন্তন সে বিদায়।
কাছে কোথাও মা পাখিটার করুন সুর ভেসে এল। যেন বন্ধু হারা এক পাখির আর্তনাদ।



"আমার এ লেখাটি শাহ্‌ জালাল জামেয়া ইসলামিয়া স্কুল এন্ড কলেজের প্রজ্ঞানে প্রকাশিত হয়েছিল। এটিই আমার লেখা প্রথম গল্প"