আমার দেখা টাওয়ার ব্রিজ

23/01/2012 12:19

লন্ডনের কথা চিন্তা করলে এমন কেউ নেই যার মাথায় প্রথমেই টাওয়ার ব্রিজের ছবি ভাসবে না! টাওয়ার ব্রিজকে লন্ডনের আইকন ধরা হয় সে কারনেই! টাওয়ার ব্রিজের কথা প্রথম শুনেছিলাম কবে আর ছবিইবা দেখে ছিলাম কবে সেটা এখন আর খুব ভাল করে মনে নেই। তবে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময়ে কামরুজ্জামান স্যার আমাদের ইংরেজি প্রথম পত্র পড়াতেন। স্যারের কাছেই শুনেছিলাম জাহাজ আসলে এই ব্রিজ খুলে গিয়ে জাহাজের জন্যে পথ করে দেয়!  সৃতিটা এখনও খুব ভাল করে মনে গেতে আছে।মূলত সেই থেকেই টাওয়ার ব্রিজ মনে গেতে গিয়ে ছিল। তবে সত্যি বলছি কোন দিন টাওয়ার ব্রিজ কাছ থেকে দেখা হবে কল্পনাও করিনি। তবে এখন পর্যন্ত লন্ডনের যত গুলো আইকন ঘুরে দেখা হয়েছে তার মধ্যে টাওয়ার ব্রিজে গিয়েছি সব চেয়ে বেশি! যত বার দেখি ততবারই যেন নতুন রুপে দেখি, সেই প্রথম দিনের মত মুগ্ধ হই! সেই প্রথম দিনের মত অপলক থাকিয়ে থাকি। যেন ব্রিটেনের নির্মাণ ইতিহাসের এক মাস্টার পিস, টাওয়ার ব্রিজ!! 

আমার প্রথম টাওয়ার ব্রিজ দেখাটা ছিল বেশ আডভাঞ্চারাস! দিনটি ছিল ২০১০ সালের ১৪ এপ্রিল। মাত্র কয়েকদিন হয়েছে লন্ডন এসেছি! কোন কিছুই ভাল করে চিনিনা! কাজিনের বাসায় উঠেছি! একদিন সকালে কাউকে কিছু না বলে বের হলাম বাসা থেকে! চলে এলাম হোয়াইট চ্যাপলের আইডিয়া লাইব্রেরিতে! এখান থেকে ম্যাপ প্রিন্ট নিলাম কিভাবে হেটে টাওয়ার ব্রিজ যাওয়া যায়! ব্যাপারটা এখনও আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয় কারন এটাই আমার হোয়াইট চ্যাপল থেকে প্রথম এবং শেষ টাওয়ার ব্রিজে হেটে আসা! আমার মনে হয়না কেউ এটা কখনও করেছে বা করার সাহস করেছে! অথবা কারো করার দরকার পড়েছে! টাওয়ার ব্রিজে লন্ডনের যেকোন জায়গা থেকে আসার সব চেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে টাওয়ার হিল পাতাল রেল ষ্টেশনে চলে আসা। তবে রেড বাস, ট্যাক্সি বা ন্যাশনাল রেলেও খুব সহজে টাওয়ার ব্রিজ আসা যায়! এছাড়া আছে নদী পথ। টেমস নদীর যেকোন পেয়ার থেকে টাওয়ার পেয়ার বা সেন্ট ক্যাথরিন পেয়ারে নেমে টাওয়ার ব্রিজে আসা যায়। এই দুটো পেয়ার টাওয়ার ব্রিজের একেবারেই কাছে!

এই ব্রিজটি একটি  bascule এবং suspension bridge। bascule ব্রিজ মানে যেসকল ব্রিজ জাহাজের পথ করে দেবার জন্যে  খুলে যায় আর suspension bridge হচ্ছে ঐ সকল ব্রিজ যেসকল ব্রিজের টাওয়ার থেকে বিশেষ ভাবে ব্রিজের ফ্লোরকে টেনে রাখা হয়। বাংলাদেশের রাঙ্গামাটিতে এরকম একটি ব্রিজ রয়েছে যা জুলন্ত সেতু নামে পরিচিত! আমি যতগুলো bascule ব্রিজ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেছি তার সব গুলোই উনবিংশ শতাব্দীতে নির্মিত এ থেকে এটা বলতে পারি এটি পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন bascule ব্রিজ!

যখন প্রথম এই ব্রিজটি নির্মাণের চিন্তা করা হয়েছিল তখন যে জায়গায় এটি নির্মাণের চিন্তা করা হয়েছিল সেখানে কোন ভাবেই কোন স্থায়ী ব্রিজ নির্মাণ সম্ভব ছিল না! কারন এটি অত্যান্ত ব্যাস্ত একটি নদী পথ হিসাবে ব্যাবরিত হচ্ছিল এবং লন্ডনের অর্থনীতিতে এর প্রভাব ছিল গুরুত্বপূর্ণ! আবার এই ব্রিজটি শুধু একটি ব্রিজ হিসাবে ব্যাবহারের চিন্তাও ছিল না! তৎকালীন শাসক শ্রেণী টেমস নদীর তীরে অবস্থিত টাওয়ার অব লন্ডনের প্রতিরক্ষা কবজ হিসাবেও ব্রিজটি ব্যাবহার করতে চাচ্ছিলেন! কাজেই একই জায়গায় নদীর নিচ দিয়ে পারাপারের জন্যে টানেল থাকার পরেও ১৮৭৭ সালের দিকে নদীর উপর ব্রিজ নির্মাণের জন্যে তৎকালীন বিখ্যাত সকল আর্কিটেক্টদের কাছ থেকে ব্রিজের নকশা আহ্বান করা হয়! এরই ধারাবাহিকতায় অল্প দিনের মধ্যেই প্রায় ৫০ টির উপরে নকশা জমা পড়ে। তবে এদের মধ্যে কোন নকশাই ব্রিজ নির্মাণের জন্যে পছন্দ হচ্ছিল না বিচারক কিংবা কর্তৃপক্ষের! পরে ১৮৮৪ সালে Sir Horace Jones বর্তমান ব্রিজের নকশাটি জমা করেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে Sir Horace Jones মূলত নকশা নির্বাচনের জন্যে একজন বিচারকের দায়িত্বে ছিলেন! আমার যেহেতু টাওয়ার আক্সিভিশনে বেশ কয়েক বার যাওয়ার সুযোগ হয়েছে সেহেতু তৎকালীন সময়ে জমা পড়া সব গুলো ব্রিজের নকশা আমার দেখার সুযোগ হয়েছে। আমার মনে হয়নি এখানে পক্ষপাত মুলক কিছু হয়েছে বরং বর্তমান ব্রিজের নকশাটি অন্য সকল নকশা থেকে সব দিক দিয়েই সেরা হবার যোগ্যতা রাখে! 

নকশা নির্বাচনের পর E W Crutwell নামক ইঞ্জিনিয়ারের তত্ত্বাবধানে ১৮৮৭ সালে পাঁচ জন ঠিকাদার এবং মোট ৪৩২ জন শ্রমিকের প্রায় আট বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে ১৮৯৪ সালের দিকে ব্রিজটির কাজ শেষ হয়! ঠিকাদারদের মধ্যে Sir John Jackson (ভিক্তি), Baron Armstrong (পানির অংশ), William Webster, Sir H.H. Bartlett, এবং Sir William Arrol & Co. বাকি অংশের কাজ করেন।

ব্রিজটি ২৪৪ মিটার লম্বা এবং এর প্রতিটি টাওয়ারের উচ্চতা ২১৩ মিটার। প্রায় ৭০ হাজার টন ওজনের দুইটা টাওয়ার প্রায় ১১ হাজার টনের ষ্টীলের ব্রিজটিকে নিয়ে দাড়িয়ে আছে। আবার দুই টাওয়ারের মাঝখানের দুরত্ব ২০০ ফিট যা আবার সমান দুইটি পাটাতনে বিভক্ত। ব্রিজটি সর্বোচ্চ ৮৬ ডিগ্রী পর্যন্ত খুলতে পারে। টাওয়ারের ডিজাইনটি করার সময়ে পাশেই অবস্থিত টাওয়ার অব লন্ডনের ডিজাইনটি সচেতন ভাবে লক্ষ রাখা হয়েছে। আর ব্রিজটির নামকরনও ব্যাবহার করা হয়েছে নিকটবর্তী টাওয়ার ব্রিজের নাম অনুসারে। ব্রিজটি নির্মাণে তৎকালীন সময়ের প্রায় ১১৮৪০০০ পাউন্ড যার বর্তমান দাম ১২২ মিলিয়ন (২০১৫ সালের হিসাবে) খরচ পড়েছিল!

প্রিন্স অব ওয়েলস পরবর্তীতে সপ্তম এডওয়ার্ড এবং তার স্ত্রী প্রিন্সেস অব ওয়েলস যিনি আলেক্সজান্দ্রা অব ডেনমার্ক নামেও বেশ পরিচিত ১৮৯৪ সালের ৩০ জুন ব্রিজটি অফিসিয়ালি উদ্বোধন করেন। টাওয়ার ব্রিজ নির্মাণের পূর্বে যেহেতু মানুষ নদী পারাপারের জন্যে পাতাল টানেল ব্যাবহার করত কিন্তু ব্রিজ খুলে দেবার পর টানেল ব্যাবহার হ্রাস পেলে ১৮৯৮ সালে টানেলটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

টাওয়ার ব্রিজের উপরের ফুট ব্রিজটি করা হয়েছিল মূলত ব্রিজ খুলার সময়ে যাতে পদ যাত্রীরা ব্যাবহার করতে পারে, তখন অবশ্য এটা ব্যাবহারের জন্যে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হত! ১৯১০ সালের দিকে উপরের ফুট ব্রিজটি বন্ধ করে দিতে হয় পকেটমার আর পতিতাদের উৎপাতের কারনে। বর্তমানেও এটি পদযাত্রীদের জন্যে সীমিত করে শুধু মাত্র যারা টাওয়ার ব্রিজ আক্সিভিশনে যান তাদের জন্যে উন্মুক্ত রাখা হয়েছে! তবে এখন সেখানে লিফটের ব্যাবস্থা করা হয়েছে! অবশ্য কেউ চাইলে সিঁড়ি ব্যাবহার করেও উপরে উঠতে পারবেন। এছাড়া ফুট ব্রিজে গ্লাস ফ্লোরের ব্যাবস্থা করা হয়েছে যা দর্শনার্থীদেরকে আলাদা ভাবে আকর্ষণ করে! এখানে একটা কথা বলে নেয়া ভাল, টাওয়ার ব্রিজের আক্সিবিশন হচ্ছে যারা টাওয়ার ব্রিজ সম্পর্কে খুব বেশি আগ্রহি তাদের জন্যে। একজন গাইড আপনাকে পুরো ব্রিজটি ঘুরে দেখতে গাইড করবেন এবং এতে আপনি টাওয়ারের ভিতরে প্রবেশের পাশাপাশি ইঞ্জিন রুম থেকে শুরু করে প্রতিটি ছোটখাট বিষয় গাইডের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন। আবশ্য এ জন্যে আপনাকে আগেই অন লাইন থেকে টিকেট করে নিতে হবে। ব্রিজের পাশ থেকেও টিকেট করা যায় তবে দাম একটু বেশি পড়বে।

জানা যায় দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময়ে জার্মান এয়ার রেইডের কারনে ব্রিজটির একটি ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে গেলে পরে নতুন আরেকটি ইঞ্জিন বসানো হয়। লন্ডনের অন্যতম ব্যাস্ত ব্রিজ হিসাবে প্রতিদিন প্রায় ৪০ হাজার মানুষ এই ব্রিজ ব্যাবহার করে। এছাড়া ব্রিজটিকে যেকোন ধরনের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে বসানো হয়েছে স্পিড ক্যামেরা, গাড়ির ওজন এবং উচ্চতা পরিমাপের ক্যামেরা! যেকোন যানবাহন সর্বোচ্চ ২০ মাইল বেগে ব্রিজ অতিক্রম করতে পারবে যার সর্বোচ্চ ওজন ১৮ টন পর্যন্ত হতে পারে।

তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে এই ব্রিজটি অনেকেই লন্ডন ব্রিজ বলে ভুল করে থাকেন। লন্ডন ব্রিজ হচ্ছে স্রোতের উপরের দিকের প্রথম ব্রিজ। এটা নিয়ে অবশ্য একটি মজার ঘটনা প্রচলিত আছে যে, ১৯৮৬ সালে Robert P. McCulloch নামক একজন আমেরিকান নাম বিড়ম্বনার কারনে টাওয়ার ব্রিজ মনে করে লন্ডন ব্রিজ কিনে নিয়ে ছিলেন। যদিও পরে তিনি তা অস্বীকার করেন।


ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করে ব্রিজের বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়। প্রথম বড় দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৫২ সালে। অন্যান্য দিনের মতই ব্রিজ খুলা হচ্ছিল। তবে যান্ত্রিক ত্রুটির কারনে সাইরেন বাজানো হয়নি! এসময় লন্ডনের ৭৮ নাম্বার বাস ব্রিজে ছিল। বাসটি যখন মাঝ পথে তখনই হঠাৎ করে পাটাতন উঠা শুরু হয়! তবে বাস ড্রাইভার মাথা টাণ্ডা রেখে বাসের গতি দ্রুত বাড়িয়ে নিরাপদে চলে যেতে সমর্থ হন! উপস্তিত বুদ্ধির জন্যে লন্ডন সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে তাঁকে তৎকালীন ১০ পাউন্ড বকশিস দেয়া হয়। ১৯৮৬ সালে  Hawker Hunter নামক একটি প্লেন, পাইলট কোন প্রকার অনুমতি ছাড়াই টাওয়ার ব্রিজের ভিতর দিয়ে উড়িয়ে নিলে প্লেন থেকে নামার সাথে সাথেই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৭৩ সালে Paul Martin নামের ২৯ বছর বয়সী একজন পাইলট একই কাজ দুইবার করেন সামান্য সময়ের মধ্যেই! পরে প্লেনের নিয়ন্ত্রন হারিয়ে দুর্ঘটনা কবলিত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তবে সবচেয়ে মজার ঘটনাটি ঘটে ১৯৯৭ সালে যখন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের গাড়ি বহর ব্রিজ খোলার কারনে দুই ভাগ হয়ে গিয়েছিল! পরে অবশ্য জানা যায় ক্লিনটনকে আগেই সময় জানি দেয়া হয়েছিল তবে ক্লিনটন নিজেই লেইট করে এরকম সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন।

প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক ব্রিজ ঘুরে দেখতে আসলেও ব্রিজ খোলার মুহূর্তটি মিস করেন। যদিও প্রতিবছর এক হাজার বারেরও বেশি সময় ব্রিজটি খোলা হয়ে থাকে! আপনারা যারা ব্রিজ ঘুরতে আসবেন তারা আসার আগে অবশ্যই এখান থেকে ব্রিজ খোলার সময়ে দেখে নিতে পারেন। এছাড়া ব্রিজের পাশে আছে অসাধারন একটি ফোয়ারা আর টাওয়ার অব লন্ডন সময় করে সেগুলোও ঘুরে দেখতে পারেন।

সবশেষে লেখা শেষ করতে চাই একটি মজার তথ্য দিয়ে! চায়না এমন কিছু নেই যে তারা নকল করতে পারেনা! মজার ব্যাপার হল চীনেও এরকম একটি নকল টাওয়ার ব্রিজ আছে যা টাওয়ার ব্রিজের মত মোট চারটি টাওয়ারের সমন্বয়ে নির্মিত! তবে ব্রিজটি লন্ডনের টাওয়ার ব্রিজের মত খোলে না!

ব্রিজটি দেখার পর হাতে সময় থাকলে ব্রিজের পাশের টাওয়ার পেয়ার থেকে বোটে ঘুরে আসতে পারেন নদী পথে ওয়েস্ট মিনিস্টার পেয়ার বা অন্য কোন পেয়ার থেকে। আমাদের দেশ নদীমাতৃক হওয়ার পরেও যেখানে আমরা নদী পথ ব্যাবহার করতে পারছিনা ভাল ভাবে, সেখানে লন্ডনের মতো উন্নত শহরে নদীপথের ব্যাবহার সত্যি আমাকে অবাক করেছে।

এদের রিভার বোট নামে এক ধরনের চাকা যুক্ত নৌকা আছে যা একই সাথে নদী এবং সড়ক উভয় পথে চলতে পারে। ব্রিজটির পাশে ২য় বিশ্ব যুদ্ধে ব্যাবরিত একটি জাহাজ রাখা হয়েছে যা আসলে একটি জাদুঘর। সময় থাকলে এখানেও একটি টু মেরে যেতে পারেন।

এ ব্রিজ আর সিলেটের কীণ ব্রিজের সাথে একটা মিল হল উভয় ব্রিজেই জালালি কবুতরের উপস্তিতি। এছাড়া সিলেটের ব্রিজের পাশের আসাধারন ফুয়ারা, আলিয়ামজাদের ঘড়ি, আধুনিক সার্কিট হাউজ, নদীর পাশে হাটার জন্যে তৈরি রাস্তা অনেক টা এ ব্রিজের মতো। আপনারা যারা এখানে আসতে পারবেননা তাদেরকে আনুরোধ করব সময় সুযোগ করে একদিন সিলেটের কীণ ব্রিজ থেকে ঘুরে আসার।